Tuesday, March 8, 2022

রক্তবিলাপ নিয়ে অল্প আলাপ

একটা সিরিজ দেখলাম - রক্তবিলাপ - দেখে নিজেরই বিলাপ করতে ইচ্ছে হলো! মানে রক্ত প্রচুর আছে - পর্বপ্রতি প্রায় দেড়খানা করে লাশ আর হাত কেটে ফেলা, মুখ ফাটিয়ে ফেলাগুলো ধরলে পুরো ব্লাডব্যাঙ্ক উপচে পড়বে। বিলাপও কম নেই - সে ব্যর্থ হৃদয়ের বিলাপই হোক কি মোবাইল নেটওয়ার্ক না পাওয়ার বিলাপ - সব ছিল। মুশকিলটা হলো যে রক্ত যুক্ত বিলাপ = রক্তবিলাপ সন্ধিটা করতে গিয়ে কেসটা পুরো জণ্ডিস হয়ে গেল।

ঘটনাটা হলো, কলেজের সাত বন্ধু - রক্তিম, সঞ্জনা (চরিত্রটির সাথে অবাঙালী কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না করেও কোনও অজ্ঞাত কারণে নামটার উচ্চারণ সাঞ্জানা করা হয়েছে, যদিও নামটার বাঙলা উচ্চারণ হয়ত রঞ্জনার মতো হতে পারত), মোক্ষ, অভি, মিয়া, গৌরব, সানি তাদের আরেক কলেজবন্ধু, মায়ার বাড়ি বেড়াতে যায়। উদ্দেশ্য - রক্তিম ও সঞ্জনার আসন্ন বিবাহের সম্ভাবনায় এক ব্যাচেলর্স পার্টি। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে মায়া একে কলেজের সবথেকে আপাত নিরীহ গোবেচারা মেয়ে, তার উপর সবাই জানে তার অসুস্থ মা শয্যাশায়ী। তবুও মায়া তার বাড়িতে হুল্লোড়টা যখন আয়োজন করে, তখন সবাই কি স্বাভাবিকভাবে সেটা মেনে নেয়। মানছি যে যুবসমাজ যুগে যুগে নচ্ছার জাতীয় হিসেবে পরিচিতি পেয়ে থাকে, তবে আমার মতে এতটাও নয় যে অসুস্থ মায়ের কথা জেনেও উদ্দাম আনন্দে রাত কাটানোর কথা সাত-সাতজন মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে মেনে নেবে। আবার সেটা মানার চেষ্টা করলেও সমস্যা হয় এটা বুঝতে যে বন্ধুর বাড়িতে এসে তার অসুস্থ মাকে চোখে দেখার কোনো জোরালো তাগিদ কেন থাকে না কারুর মধ্যে। অবশ্য গল্পের গরু তো গাছে চড়েই থাকে আর এটা তো মাত্র এক রাতের ব্যাপার, তাহলে বেশি চিন্তা না করে সেই গাছের মগডাল থেকে বাকিটার সম্বন্ধে বলে নিই।

শহরের বাইরে মায়ার বাড়িতে তো সবাই পৌঁছয়। দেখা যায় তারা পৌঁছে গেলেও মোবাইল টাওয়ার হারিয়ে গেছে। তো এসব ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই পাত্তা না দিয়ে রাতভর জমিয়ে পার্টি বসে। জলসা অবশ্য রাত বাড়তে চটকে যায় মাঝপথেই বন্ধুদের মধ্যে চলা বচসার জেরে। ব্যস, তারপর আর কি, সেই প্রায় খালি প্রকাণ্ড বাড়িটার আনাচে কানাচে ক্ষিপ্ত, বিরক্ত ও অভিমানী বন্ধুর দল ছিটকে বেরিয়ে পড়ে মনগুলোকে শান্ত করতে, আর তারপরেই শুরু হয় লাশের মিছিল। প্রথমটা বাগানে রাখা একটা বাথটবে, দ্বিতীয়টা রান্নাঘরে, তৃতীয়টা বেডরুমে, চতুর্থটা - না থাক আর বলব না, মানে লাশগুলো যেন বাড়িটার দ্রষ্টব্য জায়গা চিহ্নিত করতে থাকে আর বাড়িটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকিরা যারা তখনও জীবন্ত তারা টেরও পায় না। এমনকি একজনের খুনটা দেখায় খুনী যন্ত্রের মতো বারবার ছুরির আঘাত করছে আর যে খুন হচ্ছে সে হচ্ছে সাত চড়ে রা না কাটার অর্ধমৃত প্রতিমূর্তি।  ছুরি খাওয়াটা তার জীবনে যেন কানমলা খাওয়ার মতো স্বাভাবিক ব্যাপার যদিও কানমলা খেলেও লোকে যথেষ্ট সবাক প্রতিবাদ বা আর্তনাদ করে। যাইহোক, মৃত্যুগুলো কিন্তু প্রতিবার জানান দিয়ে হয়। ঘরের মধ্যে আলো দপদপ করে, একটা গ্রামোফোন নিজে নিজেই বেজে চলে। তা সত্ত্বেও মায়াকে কেউ জিজ্ঞেস করে না এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার কেন হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। আতঙ্কিত লোকজন বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে দেখে সেখানকার একমাত্র প্রবেশপথ বন্ধ কিন্তু কি করে জানি সেখানে জনৈক প্রেততত্ত্ববিদ প্রবেশ করে। বোধহয় আধিভৌতিক ব্যাপারে যারা পারদর্শী তারা পাঁচিল টপকানো বিদ্যা আয়ত্ত করেছে, বাকিদের বিশেষ এই জ্ঞানটি নেই, নয়তো বেছে বেছে প্রেততত্ত্ব গবেষকদের জন্য প্রবেশপথ একমাত্র খোলে। অকুতোভয় এই বাঙালী গবেষকের আবার নাক কুঁচকে ওঠে ভুতকে ভুত বললে। জানতে পারা যায় যে ঠিকটা হবে স্পিরিট, আজকাল 'আত্মা' নামক বস্তুটা বোধহয় ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। কারণ আলাদা প্রকৃতির স্পিরিট সেবিত জনতার কাছে স্পিরিট আর ভুতের তারতম্য কতটা বোঝানো গেল কে জানে? আবার এই ভদ্রলোক কি একটা যন্ত্র বের করে সেটার চার ইঞ্চির থেকেও ছোটো স্ক্রিনে কি দেখলেন, ব্যাস ভৌতিক কার্যকলাপ মুহুর্তের মধ্যে ধরে ফেললেন। গল্প পুরো তরতর করে এগিয়ে চলে যদিও শেষে গিয়ে আবার সমস্তটা আমার গুলিয়ে যায়। বিচিত্র আরেকটি চরিত্র হচ্ছে মায়াদের বাড়ির পুরনো কেয়ারটেকার, রফিককাকা। ভদ্রলোককে দেখে বিজ্ঞানের ছাত্রদের শ্রোডিঞ্জারের ওয়েভ মেকানিক্স মনে পড়তে পারে। মানে চরিত্রটি যে কি করে একবার বাগানে তো পরমুহুর্তে অন্দরমহলে চলে আসতে পারে আর বাড়িটাতে বিশেষ কিছু ঘটনার মুহুর্তে সেই জায়গায় উপস্থিত থাকতে পারে বুঝতে গেলে কোয়াণ্টাম মেকানিক্স ছাড়া উপায় নেই। তো এরকম কিছু বিচিত্র চরিত্র ও ঘটনা দেখে ভয়ানক লাগতেই পারে তবে আতঙ্ক পাওয়াটা সম্পুর্ণ দর্শকের উপর।

তাই পরের গল্পের জন্য পরিচালক জুটি - অর্নিত ছেত্রী ও মণিদীপ সাহা - দুজনকেই অনুরোধ যে আরেকটু যদি মনোযোগ দেওয়া যায় তাহলে দেখার আকর্ষণটা বাড়বে বই কমবে না। একক দক্ষতায় সপ্তর্ষি মৌলিক ও সোহিনী সরকার চেষ্টা করলেও গা ছমছমে রূপ দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বরং অলিভিয়া সরকার, প্রান্তিক বন্দোপাধ্যায় ও চান্দ্রেয়ী ঘোষ ছোটো ভূমিকায় যথাযথ।

No comments:

Post a Comment