স্বাভাবিকভাবে অনির্বাণ নামটির প্রতি আমার একটি পক্ষপাতমূলক দুর্বলতা আছে (কারন জিজ্ঞেস করলে আবার পাণ্ডব গোয়েন্দা থেকে পড়াশুনা শুরু করতে বলব)! ব্যাপারটা আরো ঘোরালো লাগছিল কারন একেনবাবু পড়তে পড়তে মনের মধ্যে এক মাঝারি উচ্চতার ছিপছিপে চেহারা ধারনা করে নিয়েছিলাম। তা অনির্বাণ চক্রবর্তী উচ্চতায় মাঝারী হলেও গড়নে ছিপছিপে বললে বেশিরকমের বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে, এরকম গোলগাল বাঙালি গোয়েন্দা ছোটো বা রুপোলী পর্দায় আগে দেখা গেছে কি না সন্দেহ! তাই চিন্তাই লাগছিল রে তোপসে! ভদ্রলোক না ঝুলিয়ে দেন সমস্তটা! কিন্তু না, সমস্ত চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে অনির্বাণবাবু সসম্মানে উত্তীর্ণ তো বটেই, সঠিকভাবে দেখলে বলা ভালো যে চরিত্রটি ওনার হাত ধরে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে স্থায়ী জায়গা করে নিল। সেই সমান আমুদে, সমান গায়ে পড়া, অত্যধিক মিশুক, অসামান্য পর্যবেক্ষণক্ষমতাসম্পন্ন, বিশ্লেষণি মনের অধিকারী, রসিক, অত্যধিক কৌতুহলি, বিনয়ের বিরক্তিকর অবতার। বদল অবশ্য হয়েছে, তবে সেটা সময় ও জায়গার। বইয়ের একেনবাবু গোয়েন্দা হিসেবে আমাদের কাছে দেখা দিয়েছিলেন বাঙলা তথা ভারতের বাইরে - মার্কিন মুলুকে আর ইনিও বাঙলার বাইরে থেকে শুরু করলেন তবে ব্যাঙ্গালোরে। নামটা জানি ব্যাঙ্গালুরু বলা উচিত ছিল, কিন্তু পুরনো নামটাই বেশি শ্রুতিমধুর লাগে আর একেনবাবু নিজে যেখানে দৃঢ়তার সাথে একের পর এক ভুলভাল প্রবাদ বলে চলেন, সেখানে এরকম অল্পবিস্তর ভুলত্রুটি চলতে পারে মনে হয়, মানে যেখানে বক্তব্যটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। তবে দর্শকরা চিন্তা করবেন না। শুরুটা ব্যাঙ্গালোর হলেও কোনোটাতে উনি ঢাকায় আবার কোনোটাতে খোদ বাঙলায়।
সিরিজটির আপাতত চারটে মুক্তিপ্রাপ্ত গল্পের মধ্যে রহস্যের হাতছানি প্রধান হলেও সেটাকে এক হাসির মোড়কে উপস্থাপনা করাটাই একে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। গোয়েন্দা চরিত্রটি নিজেই যেখানে তার চালচলনে কৌতুক উদ্রেক করে সেখানে খানিকটা অন্যরকম তো হবেই। এ যেন অনেকটা জটায়ুর মোড়কে ফেলুদা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই মাথার ভিতরে কি চলছে। এনার চোখে যেমন নতুন দেখা সবকিছুই স্বাভাবিক বিস্ময় উৎপাদন করে কিন্তু অস্বাভাবিক কোনোকিছু নগন্য হলেও, সহজেই ধরা পড়ে। নিজের চেহারা আর স্বভাবের স্বাভাবিক কৌতুকের আড়ালে তাই ইনি হয়ে ওঠেন এক ধুরন্ধর প্রতিপক্ষ, যাকে এড়ানো মুশকিল। চরিত্রটা শুনতে মজাদার হলেও আমার ধারনা অভিনয়টা কঠিন, আর এখানেই অনির্বাণবাবুর বৈশিষ্ট্য ধরতে পারা যাবে! ঠাট্টার মোড়কে নিজেকে উপস্থাপন করেও চরিত্রটার মর্যাদা ক্ষুন্ন করেননি। সেইজন্য হাজার বিরক্তি হাজির করেও তিনি হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয়, বুদ্ধিদীপ্ত, শান্তশিষ্ট, বিপদে অবিচল, স্ত্রীয়ের নাম শুনলে বিচলিত, খাদ্যরসিক, আদ্যন্ত বাঙালি এক হাসিখুশী গোয়েন্দা। ধারাবাহিকটির পুরো কৃতিত্ব একজনকে দিলেই হবে না, পরিচালকরাও তার সমান কৃতিত্বের অধিকারী। যেখানে বহু পরিচালক মিলে একটি ধারাবাহিক এগিয়ে নিয়ে যান, সেখানে পর্বের মধ্যে চরিত্র ও পরিবেশনার সামঞ্জস্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেখানেও মিলিতভাবে সফল সুরজিত চ্যাটার্জি, অনির্বাণ মল্লিক, জয়দীপ মুখার্জী, অনুপম হাড়ি ও অভিজিত চৌধুরী। ধারাবাহিক সিরিজটি যত এগিয়েছে গল্পগুলো যেন তত পরিণত হয়েছে। এটাও খুব একটা দেখা যায় না কারন ধারাবাহিক অনেকদিন ধরে চললে একঘেয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর পরেরদিকের পর্বগুলো কম আকর্ষণীয় হয়ে যায়। মাঝখানে কিছু মাসের বিরতি নিয়ে তৈরী বলেই হয়তো সিরিজটি মনোযোগ দিয়ে বানানো হয়েছে তার মানের দিকে নজর রেখে। চিত্রনাট্য ও সংলাপও পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, শমিতা দাশ ও সুজন দাশগুপ্তের লেখনীতে মজবুত হয়ে উঠেছে যার জন্য পরেরদিকের পর্বগুলো আরো জমাটি হয়ে উঠেছে। তবে একটা ব্যাপারে দর্শকদের খেয়াল রাখতে হবে খানিক! সেটা হল আকর্ষণীয় হওয়ার সাথে সাথে গল্পগুলোর বিষয়বস্তু কিছুটা প্রাপ্তবয়স্কদের হয়ে গেছে। সেইজন্য ছোটোদের সাথে দেখলে একটু বুঝেশুনে দেখা দরকার।
বিভিন্ন কাহিনীতে একেনবাবু সঙ্গে পেয়েছেন সঙ্গীসাথি যাদের মধ্যে বাপ্পাদিত্য ওরফে বাপীবাবু অন্যতম। একেনবাবু ব্যাঙ্গালোরের হোটেল থেকে উৎখাত হওয়ার পর দায়িত্ববান নিপাট ভালোমানুষ, বাপীবাবু তাদের দুজনের পরিচিত বন্ধুর অনুরোধে একেনবাবুকে নিজের বাড়িতেই থাকতে দেয়। হাসিমুখে অন্যের আপদে বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ানো, চাকরীসুত্রে ভিনরাজ্যের অধিবাসী বাঙালি এই চরিত্রটিতে সৌম ব্যানার্জীকে দারুন মানিয়েছে। উলটো দিকে কারনে অকারনে মাথা গরম করে ফেলা বাপীদের আবাসনের বন্ধু প্রমথর চরিত্রে দেবপ্রিয় বাগচী সঠিক নির্বাচন। এরকম কিছু সঙ্গীসাথী একেনবাবুর জুটে যায় রহস্যের সমাধানে বেরিয়ে। বন্ধুবান্ধব অবশ্য প্রতিবার সাথে থাকতে পারে না, কিন্তু আত্মীয় পরিজন কেউ ঠিক জায়গাটা নিয়ে নেয়। এরকম একটি রহস্যে সাথী হিসেবে পান নিজেরই এক সম্পর্কের বোনকে। অনুরাধা মুখার্জী অভিনীত চরিত্রটি তার বন্ধুর বাড়িতে থাকাকালীন এক রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। সেখানে একেনবাবু যেচে অতিথি হয়ে আসেন আর তারপর জটিল এক খুনের কিনারা করতে এগিয়ে যান।
রহস্যে ভরা পর্বগুলো কখনও একঘেয়ে লাগেনা বিষয়ের নতুনত্বে আর হাসির আবহে। সামনে আসা সমস্যা যতই গুরুতর হয়ে উঠুক না কেন, তার সমাধান ঠাট্টার আড়ালে করে একেনবাবু হয়ে উঠেছেন সবার থেকে আলাদা।
No comments:
Post a Comment