Saturday, December 4, 2021

মন্দার.....অসাধারনের মাঝে সাধারন

যেটা হওয়ার কথা ছিল অনন্যসাধারণ, সেটা সাধারণ আর অসাধারণের মাঝে ঝুলে রইল। কিন্তু এরকম তো হওয়ার ছিল না। সমস্ত উপাদান তো মজুত ছিল। কিন্তু মন তো ভরল না পুরো। কোথায় যেন গণ্ডগোল থেকে গেল। অনির্বাণ ভট্টাচার্য পরিচালক বলে কি প্রত্যাশাটা খুব বেড়ে গেছিল? ব্যাপারটা কি অন্যরকম কিছু হবে ভেবেছিলাম? খানিকটা যে তাই তা বলাই বাহুল্য। অভিনেতা অনির্বাণের প্রথম পরিচালনা দেখার আগ্রহ যথেষ্ট ছিল। তাহলে তো আগে দেখতে হয় পরিচালক অনির্বাণ কি করেছেন।

পুরোটা সংক্ষেপে বোঝাতে হলে বলতে হবে মাৎ করে দিয়েছেন। প্রেক্ষাপট নির্বাচন, চরিত্র নির্বাচন, ভাষার নির্বাচন - এগুলো তো বটেই কিন্তু এদের মধ্যে সাযুজ্য বজায় রাখার সামগ্রিক নিষ্ঠা সমসাময়িক যুগের বিচারে অতুলনীয়। অভিনেতাদের নিজস্ব অভিনয় ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনোরকম মন্তব্য না করেও চয়ন দেখে যেন মনে হয় তাঁদের জন্যই চরিত্রগুলো গড়া। চিত্রায়ণে সৌমিক হালদার এক অনন্য মাত্রা দিয়েছেন সমস্ত উপস্থাপনাটিকে। কাহিনীর প্লট অনুযায়ী ড্রোন শট হোক কি চেহারার ক্লোজ আপ, প্রায় প্রত্যেকটি শট নির্ভুলভাবে ফুটিয়ে তুলেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে মানবজাতির কদর্য বাস্তব। হিংসার তাড়না, প্রতিহিংসার উল্লাস, লালসার বিভৎসতা, মানসিক বিকৃতি, ইত্যাদি বিভিন্ন প্রবৃত্তির বর্বর রূপ ও ঘটনার রূপকারদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশকে নির্ভুল অথচ শিল্পের অনবদ্য আঙ্গিকে ধরা হয়েছে। চিত্রের ভারসাম্য বজায় রেখে সমকৃতিত্ব দাবী করে সোমনাথ কুণ্ডুর সাজসজ্জা বিভাগ।

ম্যাকবেথ অবলম্বনে তৈরি মন্দারের পটভূমি গেইলপুর নামক এক সৈকত নগর। সেখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশ মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ভুক্ত। গোষ্ঠীর ব্যাবসার দিকটা চলে তাদের সর্দার ডাবলুভাইএর (কিং ডানকান) নেতৃত্বে। কঠিন হাতে কর্তৃত্ব জারি রাখতে খুন-জখম-ত্রাসসঞ্চার করার অন্ধকার দিকটা দেখার জন্য তার ভরসার লোক মন্দার (ম্যাকবেথ) ও বঙ্কা (ব্যাঙ্কো)। ক্রুরতা ও রহস্যে ঘেরা কিছু ঘটনার স্রোত এদের তিনজনের মনে আশঙ্কা-সন্দেহ-লালসার বীজ বপন করে দিল। তারপর শুরু হলো ক্ষমতা কায়েম ও প্রতিহিংসার এক রক্তাক্ত অধ্যায়। অবিশ্বাস ও স্বার্থপরতার এক অন্ধকার লড়াইয়ে প্রাণের মূল্য হয়ে গেল গৌণ। ভাগ্যের পরিহাসে রাজার আসন দখলের আকাঙ্খায় বন্ধু হয়ে পড়ল শত্রু, শক্তির মত্ততায় পরমাত্মীয় হেলায় নেমে গেল ব্যাভিচারের অতলে। লালসার এই ঘৃণ্য আসর ম্যাকবেথের পঞ্চ অঙ্কের মতোই পাঁচ পর্বে সমাপ্ত। শেক্সপিয়রের অনুপ্রেরণায় রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায়, প্রতীক দত্ত ও পরিচালকের নিজের কলমের ফসল এই কাহিনীর গতিময়তা ও শ্বাসরোধকারী মুহুর্তগুলো প্রতীকবাবুর ঠাসবুনট চিত্রনাট্যে প্রায় অধিকাংশক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে এক ভয়াল বাস্তবের প্রতিবিম্ব।

অভিনয়তে মুখ্য চরিত্র বাদ দিয়েও পার্শ্বচরিত্রে লোকনাথ দে (মদন) ও শঙ্কর দেবনাথ (বঙ্কা) অসাধারন। সোহিনী সরকারও (লাইলি) একাধারে অসহায়, আবার পরক্ষণেই নির্মম চরিত্রে কঠিন ও সুন্দর। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে দেবেশ রায়চৌধুরী (ডাবলুভাই) ও দেবাশিস মণ্ডল (মন্দার) দুই মুখ্য ভূমিকায় অনবদ্য। চরিত্রদের সাথে একাত্ম হয়ে পড়া এই দুজনের অভিনয় মান নিয়ে যে কোনো প্রকারের তারিফই কম শুনতে লাগবে। বিপরীতে অনির্বাণ (মুকদ্দর মুখার্জি) নিজে প্রয়োজনের অধিক মৃয়মান।

এবার তাহলে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এতকিছুর পর সমস্যার কথাটা উল্লেখ করলাম কেন? করলাম তিনটি প্রধান কারণে যেগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ঠিক লাগেনি। প্রথমত, চরিত্রদের নীচ মনোবৃত্তি বোঝানোর জন্য অশ্লীলতা পরিবেশনার মধ্যে যদি কিছুটা অন্যরকম কিছু করে দেখানো যেতো তাহলে বলতাম যে নতুন কিছু দেখলাম। সেখানে নতুন দেখলাম বটে, তবে তা শিল্পগুণে অত্যন্ত সাধারণ বললেও অত্যুক্তি হবে। দ্বিতীয়ত, সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি ওয়েব সিরিজ। তাহলে নাটকীয়তার আধিক্য থাকাটা অনুচিত। থাকলে সেটা বেশ অস্বস্তিকর লাগে। মন্দারের মশারী জড়িয়ে জালে পড়ে যাওয়া প্রভৃতি দৃশ্য শিল্প হিসেবে উচ্চ মানের হতেই পারে, কিন্তু এরকম কিছু নাটকীয়তার প্রাবল্য ছোটোপর্দার দৃশ্য হিসেবে বিসদৃশ্য ও দৃশ্যের ধারাবাহিকতাকে হঠাৎ করে যেন অকারণ অস্বাভাবিকতার প্রলেপ দিয়ে দৃশ্যের মান সাধারন করে দিয়েছে। তৃতীয় হচ্ছে বিষয়। কয়েকটি চলচ্চিত্রের উল্লেখ করে জিনিসটা বোঝানোর চেষ্টা করব। একটি হলিউডি, দুটি বলিউডি ও দুটি টলিউডি। শেক্সপীয়রের 'ম্যাকবেথ' অনুসরণে বিশাল ভরদ্বাজের 'মকবুল', 'জুলিয়াস সিজার' ও 'অ্যাণ্টনি অ্যাণ্ড ক্লিওপেট্রা' অবলম্বনে সৃজিত মুখার্জির জুলফিকর (অনির্বাণ যার কিছু ঝলক ব্যবহার করেছেন প্রায় সমান্তরাল এক পরিস্থিতিতে), 'হ্যামলেট' অনুসরণে অঞ্জন দত্তের 'হেমন্ত', 'ওথেলো' অবলম্বনে বিশাল ভরদ্বাজের 'ওমকারা' ও টিম ব্লেক নেলসনের 'ও'। আশ্চর্যভাবে অঞ্জন দত্তেরটা বাদ দিয়ে বাকি তিনটি ভারতীয় সংস্করণ সমাজবিরোহীদের অন্ধকার জগতের প্রেক্ষাপটে রচিত। কিন্তু এই প্রলোভনের হাতছানি এড়িয়ে বেশ অদ্ভুতভাবে নেলসন নির্মিত আধুনিক ওথেলো মানুষের অন্ধকার দিকটা দেখিয়েছেন আপাত শিক্ষিত সমাজের প্রেক্ষিতে এবং তাই হয়ে উঠেছে মৌলিকতায় ভাস্বর। অঞ্জন দত্ত চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁরটাও প্রতিশোধের প্রেক্ষিতে প্রায়ান্ধকার পরিবেশে পর্যবসিত। তবে কি হলিউড শুধু শিখিয়েই যাবে আর আমরা শিখেই যাব? হিংসা-প্রতিশোধ মানেই যে অন্ধকার জগত নয় সেটা কবে বুঝব? আইনের হাত এড়িয়ে অন্যায়ের শাস্তি বোধহয় শেক্সপীয়র চাননি। 'ম্যাকবেথ' পড়া থাকলে ও 'মকবুল' দেখা থাকলে 'মন্দার'-এ নতুন কিছু নেই। এখানেই খেদ! সমকালীন যুগে অনির্বাণ এক আলাদা মাপের অভিনেতা। সেকারণে তাঁর থেকে পরিচালনাটা আরো মৌলিক চেয়েছিলাম। পেলাম না, তবে অপেক্ষা করব ভবিষ্যতের চাকার মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য।

1 comment:

  1. নব্য সমালোচক অনির্বাণ দের এর পরিবেশনা প্রশংসনীয়।-Amrita De

    ReplyDelete