Thursday, November 18, 2021

অদ্বিতীয় ব্যোমকেশ

হইচইয়ে এই মাসে সৌমিক হালদার পরিচালিত ব্যোমকেশ ওয়েব সিরিজের সপ্তম সিজন প্রদর্শিত হল। খুব আগ্রহ সহকারে দেখলাম। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় রচিত চোরাবালি গল্প অবলম্বনে সৌগত বসুর গতিময় চিত্রনাট্য শৌভিক বসুর নিপুণ চিত্রায়নে এক শৈল্পিক আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় ব্যোমকেশের চরিত্রে। অজিতের চরিত্রে সুপ্রভাত দাস সাথে সাথে চতুর্থ সিজন থেকে সুব্রত দত্তের পরিবর্ত হিসেবে কাজ করছেন কিন্তু দুজনেই চরিত্রটির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত আশ্চর্যভাবে সমরূপে ধরে রেখেছেন যা অবশ্যই কৃতিত্বের দাবী করে। বিপরীতে সত্যবতী চরিত্রে রিদ্ধিমা ঘোষ যোগ্য সঙ্গত রেখেছেন মুখ্য ব্যক্তিত্বের সাথে। পার্শ্বচরিত্রগুলির মধ্যে অর্জুন চক্রবর্তী বোধহয় হিমাংশু চরিত্রের শিকারী সত্ত্বার সাথে অতিমাত্রায় একাত্ম হতে গিয়ে খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে পড়েছেন আর কিঞ্জল নন্দ হিমাংশুর বন্ধু কুমার ত্রিদিবের বন্ধুবৎসল জমিদারী ব্যক্তিত্বের সাথে মিশে থেকেও মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর। তবে দেওয়ান কালিগতির ভূমিকায় চন্দন সেন অনবদ্য। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে স্বীকার করতেই হবে এবারের পরিবেশনাটিও বাকিগুলির মতোই আকর্ষণীয় এবং তাদের মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধের ছাপ রেখে পরিণতবয়স্কদের প্রসঙ্গ অবতারণা করলেও পরিচ্ছন্ন।

সমস্যা হচ্ছে পরিমিতি বোধটা অধিকাংশ জায়গায় থাকলেও পুরোপুরি থাকেনি। গল্পের গোয়েন্দা চরিত্রের মধ্যে আমার কাছে ব্যোমকেশ উপরের সারিতে থাকবে। তাই তাকে নিয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেখলে ঠিক মনে হয় না। সায়ন্তন ঘোষাল পরিচালিত প্রথম সিজনে দুটি গল্পকে সমান্তরালে পরিবেশন করা হয়েছিল। সত্যান্বেষীর সাথে পথের কাঁটা, অর্থমনর্থমের সাথে মাকড়সার রস, বিষয় অথবা চরিত্রদের সামঞ্জস্য ব্যবহার করে একসাথে দুটি প্লটকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এক অভিনবত্বের সুচনা করেছিলেন পরিচালক। ভালো লেগেছিল। একই ভাবনার ব্যবহার পঞ্চম সিজনে দেখা গেছিল। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এই সিজনেরই পরিচালক। বাঙলার কুখ্যাত মন্বন্তরের পরিপ্রেক্ষিতে দুষ্টচক্র ও খুঁজি খুঁজি নারি উপস্থাপনা করা হয়েছিল। এবারের দুটি পর্বের মতোই সেবারও পর্বের সংখ্যা ছিল এক জোড়া। ষষ্ঠ সিজনে পেলাম মগ্ন মৈনাক যা আমার মতে এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ। কিন্তু পঞ্চম সিজন থেকেই ব্যোমকেশের মধ্যে সমাজের অসহায়তার প্রতি একটা রাগ-দুঃখ-অভিমান পরিস্ফুট হতে দেখা গেল যা শুধুমাত্র তার কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, অন্যের সাথে কথাবার্তায় বেরিয়ে পড়তে লাগল, আর বেরোতে লাগল তার কাব্যিক সত্ত্বা। ব্যোমকেশ যেন আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু সেটার জন্য এই অতিনাটকীয়তার পরিবেশ অপ্রয়োজনীয়। কারণ ব্যোমকেশের গোয়েন্দাদের আবশ্যিক শর্তের মধ্যে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি বিশ্লেষণ ক্ষমতাও তীব্র। কিন্তু এসবের উপর অসাধারন দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তার অন্যান্য গোয়েন্দাদের থেকে স্বতন্ত্র থাকার প্রধান কারণ তার সত্যের অনুসন্ধানের প্রতি একনিষ্ঠতা। তার আবেগ হচ্ছে সত্যকে জানার আবেগ, এতেই তার প্রধান সন্তুষ্টি, এটাই তার আসক্তি, সত্যকে জানার লক্ষে সে অবিচল। সে অবশ্যই সংসারী হতে পারে, পারিপার্শ্বিকতার অসহায়তা তার মনকে করুণ করতেই পারে। কিন্তু আমার মতে, সে এগুলোর প্রকাশ কারুর সমক্ষে করবে না। তার কষ্ট, বেদনা হবে তার একান্ত আপনার। যা অজিতের সাহিত্যিক মনকে সহজে নাড়া দিতে পারবে বা সত্যবতীর নারীহৃদয়কে সহজেই স্পর্শ করবে, সেই একই ব্যাপার ব্যোমকেশের যুক্তিবাদী মনকে তার মূলে অনুসন্ধান করতে প্ররোচিত করবে আর যদি সে বুঝতে পারে যেই সমস্যার সমাধানে তার অসহায়তা, সে অস্থির হবে, কিন্তু সে থাকবে নিরব কারণ বৃথা আলোচনার দ্বারা যে কিছু হওয়ার নয় সেটা অন্যেরা না বুঝলেও সে অবশ্যই বোঝে। সমাজের তথা সামাজিক জীবের মনস্তত্ত্ব যার নখদর্পণে, সেই হবে অজিত ও সত্যবতীর মানসিক সহায় কারণ উপযুক্ত শ্রোতা যদি ধৈর্য সহকারে অসহায়তার মনস্তত্ত্ব বুঝতে আগ্রহী হয় তাহলে তার থেকে বিচক্ষণ শিক্ষকের জুড়ি মেলা ভার। সংসারী ব্যোমকেশের সাংসারিক জীবনে সাহিত্যের বাহ্যিক প্রকাশের জন্য অজিত উপস্থিত, আছে সত্যবতীর মতো বুদ্ধিমতি শিক্ষানুরাগী স্ত্রী, কিন্তু সত্যান্বষণের পথে নিবেদিত হৃদয়, ব্যোমকেশের প্রাণে সাহিত্য সঞ্চার প্রয়োজন না থাকলে অনভিপ্রেত।

এত কথা বলছি এই কারণেই যে এই সিরিজগুলি পরিবেশনায় অন্যান্য অনেক ব্যোমকেশের চিত্রায়িত উপস্থাপনার থেকে শুধুমাত্র তার পরিমিতি বোধের কারণে আকর্ষণীয় এবং স্বতন্ত্রতায় উজ্জ্বল। সিজনগুলির পরিচালকদের মধ্যে উল্লেখিত দুজন ছাড়াও সৌমিক চট্টোপাধ্যায়ও একই ধারা বজায় রেখেছেন যা অবশ্যই আন্তরিক অভিনন্দনের অধিকারী। তাই সবার থেকে আলাদা বহু প্রতিক্ষিত এই সিজনগুলির এই ত্রুটিটুকু না থাকলে সিরিজটি সর্বতোভাবে সুন্দর হতে পারবে।

সপ্তম সিজনে ফিরে এসে দুটো সমস্যার উপর আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, শরদিন্দু বর্ণিত হিমাংশু প্রকৃতিতে উদার ছিলেন। তাকে অমলিন করে দিয়ে খুব কি লাভ হলো? উপরন্তু তার প্রতি ব্যোমকেশ নির্ধারিত শাস্তির মাত্রা বিচারককে তার প্রকৃতিবিরুদ্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, শিকারপ্রিয় হিমাংশুকে যদি সর্বক্ষণ শিকারীর পোষাকে দেখা যায়, সেটাও দৃষ্টিকটু লাগে!

এই মুহুর্তে অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও আরেকটি ব্যাপার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বাঙলা রহস্য রোমাঞ্চ সাহিত্যে শরদিন্দু ও সত্যজিৎ দুই বলিষ্ঠ রূপকার। শরদিন্দুর সৃষ্ট ব্যোমকেশ ও সত্যজিতের কল্পনার ফেলুদা অমর হয়ে আছে তাদের নিজস্বতায়। এই সিজনের একটি দৃশ্যে ছোট্ট বেবির সাথে ব্যোমকেশের পরিচয় এবং আলাপ জয় বাবা ফেলুনাথে চিত্রায়িত ফেলুদার সাথে রুকুর পরিচয়পর্ব স্মরণ করায়। দৃশ্যটির অবতারণা অনাবশ্যক এবং পরবর্তী পর্যায়ে রায়পরিবার নিয়ে আলোচনা ভীষন ভাবে কৃত্রিম। শরদিন্দু আর সত্যজিত যে যার আপন সৃষ্টির মধ্যেই উজ্জ্বল। তাদের সেরকমভাবে মনে রাখাই শ্রেয়।

No comments:

Post a Comment