Saturday, July 30, 2022

একেই বলে ফেলুদা: ফেলুদা ফেরত ও ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি

কিছু গল্প আছে যা কখনো পুরনো হয় না। কিছু ছায়াছবি আছে যা বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। কিছু মানুষের কথা মনে পড়লেই মনটা ভালো হয়ে যায়। কিছু চরিত্রের কথা মনে পড়লে আবার মনটা সজীব হয়ে যায়। এগুলোর উদাহরণ ক্রমানুসারে দিতে গেলে বলব
- ফেলুদার গল্প
- সোনার কেল্লা
- সত্যজিৎ রায় নামক মানুষটি
- জটায়ু ছদ্মনামের আড়ালে থাকা চরিত্রটি
তাই যেই শুনলাম যে ফেলুদা গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে আবার ফেরত আসছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নতুনভাবে রুপোলী আত্মপ্রকাশ দেখতে তৈরি হলাম। গল্পটা নিয়ে মাথাব্যাথা আলাদা করে কখনই কিছু ছিলোনা, পরিচিত কাহিনীর কল্পনার জগত থেকে আসা ফেলুদাকে ছবির পর্দায় যে কিছুক্ষণের জন্য হলেও রক্তমাংসে দেখতে পাবো, ভাবলেই অন্যরকমের আবেশ তৈরি হয় মনের মধ্যে। তারপর তো সাথে আছে তোপসে আর লালমোহনবাবু। সত্যি বলতে কি ফেলুদা নিয়ে ছায়াছবি করলে আকর্ষণটা বেশি থাকে কে অভিনয়টা করছে তার উপর। গল্প তো জানা, কিন্তু গল্পটাকে কিভাবে দেখানো হচ্ছে সেটার উপরই পুরো গুরুত্বটা নির্ভর করে। ব্যাপারটা পুরো বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্নের মতো। জানি যে মাংস হবেই কিন্তু সেটা রোগান জোশ হিসেবে কি রেজালারূপে কি তন্দুরের আড়ালে পেটে প্রবেশ করছে, তার উপরেই পুরো পরিবেশনের সার্থকতা নির্ভর করছে। সত্যজিত, সন্তোষ দত্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ব্যঞ্জন আমাদের যে তুলনাহীন শিল্পের জাদুতে মাতিয়ে রেখেছিলেন, তার আশা অবশ্য করি না, কিন্তু ফেলুদার উপন্যাস হচ্ছে শুনলেই মনটা কেমন করে ওঠে। মনে হয় এবার বুঝি আবার সেই জাদুটা ফিরে আসবে। ঘটনা হচ্ছে, এবার কিন্তু সত্যিই সেই আশাটা বেড়ে গেল। ফেলুদাকে যেন সেই পুরনো গোয়েন্দাগিরির ঢংএ ফেরত পেলাম। কেউ যেন আমাদের অবশেষে বুঝলেন। পরিচালক সৃজিত মুখার্জ্জীকে তাই সবার প্রথমে কৃতজ্ঞতা জানাই। কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক মোবাইল যুগের সময়োপযোগী করার অহেতুক অস্বাভাবিকতায় না মুড়ে ফেলে পরিচালক ফেলুদাকে খানিকটা হলেও পুরনো নিজস্বতায় ফিরিয়ে এনেছেন। সময়টা কাহিনী অনুযায়ী থাকলে দর্শকদের কয়েক দশক পরেও যে গল্পটার প্রেক্ষাপট বুঝতে অসুবিধে হয় না সেটা নিয়ে বোধহয় এবার আর কোনও সংশয় থাকবে না। রহস্যটা যেখানে আসল, সেখানে কাহিনীর মূল সময়টা কয়েক দশকের পুরনো হলে ক্ষতি কি? যুগটা বরং অবিকৃত রাখলেই তো কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনাগুলোর গতিপ্রকৃতি স্বাভাবিক থাকে। সৃজিতবাবুকে সাধুবাদ এই খেয়ালটা রাখার জন্য। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফেলুদার ভূমিকায় টোটা রায়চৌধুরী। এই ফেলুদা যেন বইয়ের ছবি থেকে উঠে আসা ফেলুদা। বছরকয়েক আগে ‘টিনটোরেটর যীশু’ ছায়াছবিতে এই ভদ্রলোককে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতে দেখে মনে হয়েছিল এই যেন রুপোলী পর্দার জন্য ঠিকঠাক পরের ফেলূদা। সেইজন্য টোটা রায়চৌধুরী অভিনীত ফেলুদা চরিত্রটিকে পেয়ে আমার উৎফুল্লতা দেখে আমাকে পক্ষপাতদুষ্ট লাগতেই পারে। মনের মতো চেহারার ফেলুদা পেলে কে না খুশি হবে? কিন্তু এই খুশিটা যে চিরস্থায়ী হলো না সেখানেই খেদ। সৃজিত-টোটা অনুষ্ঠিত যুগলবন্দী ফেলুদার বাহ্যিক দিকটির দিকে একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলে তার গোয়েন্দা সত্ত্বার সাথে মানানসই ব্যক্তিত্বের দিকটির প্রতি খানিকটা হলেও কম গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন, মাঝেমধ্যেই অকারণ ঔদ্ধত্বের প্রকাশ হয়েছে ফেলুদার সংলাপে যা তার আত্মবিশ্বাসী ধৈর্যশীল চরিত্রের পরিপন্থী। বাচনপটুতা ও বাচনশৈলীর মধ্যে তফাতটা খেয়াল রাখলেই এই সমস্যাটা আর থাকে না। তারপর পরের দিকে যদিও ফেলুদা অনেকটা সাবলীল কিন্তু প্রথমদিকের কাহিনীতে ফেলুদার মেকআপ ভীষনভাবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথে’এর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো হয়ে গিয়েছিল যে খোলসের মধ্যের টোটা রায়চৌধুরীকে যেন খুব আড়ষ্ট করে রেখেছিল। তবে সবথেকে যেটা ভালো লেগেছে সেটা হলো জটায়ুর সাথে ফেলুদা আর তোপসের সম্পর্কটা যে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব আর রসিকতার সেটা সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলাটা।
তবে ফেলুদাকে নিয়ে যাই বলি না কেন, লালমোহনবাবু কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছে। মানে, জটায়ু চরিত্রে অনির্বাণ চক্কোত্তি যে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন, সেটা কিন্তু হলফ করে বলতে পারা যায়। সন্তোষ দত্তের পরে এরকম জটায়ু আগে চোখে পড়েনি কখনও। একাধারে রহস্যরোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় অথচ ভীতস্বভাবের বাঙালী, অন্যধারে বন্ধুবৎসল ভালোমানুষ গোছের এক মজাদার ব্যক্তিত্ব, মানে জটায়ু বলতে ঠিক যা মনে হয়, অনির্বাণবাবু আমাদের ঠিক সেটাই উপহার দিয়েছেন। জটায়ুর পর্যবেক্ষণক্ষমতা যে সাধারণের মতোই ও সাধারন জ্ঞান অতি সাধারন, সেটা ফেলুদাদের কাছে কখনো ব্যাঙ্গের না হয়ে শুধু সৌহার্দপুর্ণ রসিকতার জায়গাতেই সীমাবদ্ধ সেটা অনেকে বুঝতে পারেন না। লালমোহনবাবুর ব্যক্তিত্ব খর্ব না করেও যে চরিত্রটিকে মজায় মোড়া যায়, সেই কৃতিত্ব চক্রবর্তী-মুখার্জ্জী দেখিয়ে দিয়েছেন। জটায়ু যে কখনোই ফেলুদাদের কাছে উপহাসের পাত্র হতে পারেন না, সেই ব্যাপারটা অনেকেই ধরতে পারেন না। এই পরিচালক পেরেছেন ও সেজন্য ওনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
তুলনায় কল্পন মিত্রকে তোপসের চরিত্রে বেশ খানিকটা ম্রিয়মান লেগেছে। পরের কাহিনীতে তাকে আরেকটু কম সলজজ দেখালে বোধহয় সঠিক দেখাবে।
রম্যদিপ সাহার মনোমুগ্ধকর চলচ্চিত্রায়ণ চারপাশের দৃশ্যগুলিকে যেমন অনন্য মাত্রা দিয়েছে তেমনি তন্ময় চক্রবর্তীর শিল্প নির্দেশনা, সাবর্ণী দাশ রচিত সাজসজ্জা, প্রসেনজিৎ ব্যানার্জ্জী ও মলয় মুখার্জ্জীর মেকআপ চরিত্রগুলিকে গল্পের বর্ণিত সময়ের সাথে উপযোগী করে তুলেছে। জয় সরকারের সঙ্গীতের ও শ্রীজাতর কথায় রূপঙ্কর বাগচী, রূপম ইসলাম, অনিন্দ্য চ্যাটার্জ্জী, শিলাজিত মজুমদার, অনুপম রায় ও সিদ্ধার্থ রায় সুরের জাদুতে ধারাবাহিকগুলোর মুখবন্ধের লগ্ন থেকেই জমিয়ে দিয়েছেন। পার্শ্বচরিত্রে ধৃতিমান চ্যাটার্জ্জী, অরুণ গুহঠাকুরতা, রাহুল ব্যানার্জ্জী, মৈনাক ব্যানার্জ্জী ও সুপ্রভাত দাসের অভিনয় নজর কাড়ার মতো।
তাই বলছি যে ফেলুদা-লালমোহন-তোপসে ভক্তদের কাছে আড্ডাটাইমস ও হইচইতে চলা এই দুটি সিরিজ খুবই চিত্তাকর্ষক লাগবে।
তবে পরিচালকের প্রতি একটাই অনুরোধ। ফেলুদামাত্রেই ছোটোবড় মিলে একসাথে দেখার ছায়াছবি। একটি বিশেষ জায়গায় কিন্তু একটি প্রাপ্তবয়স্কমার্কা দৃশ্যের ঝলক চোখে পড়ল! এরকম দৃশ্য যদি অবতরণ না করা হয়, খুব অসুবিধা হবে কি কারুর? পরিচালক ভবিষ্যতে যদি এই ব্যাপারটা খেয়াল রাখেন, ফেলুদাভক্ত হিসেবে তবে নিশ্চিন্তে থাকা যায়।